পবিত্র কোরআন এর আলোকে শবে বরাতের বৈধতা

দরসে কোরআন

পবিত্র কোরআন এর আলোকে  শবে বরাতের বৈধতা

الحمد لله وكفى والصلوة والسلام على سيد الانبياء محمد المصطفى وعلى اله واصحابه اولى الصدق والصفاء-

যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দান করে থাকেন, শবে বরাত তারই অন্যতম। রাতটি হলো শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সলফে সালেহীন এবং বিজ্ঞ মনীষীগণ এ রাতটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালন করেছেন। অনুরূপভাবে যুগে যুগে মুসলমানগণ এরই ধারাবাহিকতায় এ রাতটি পালন করে আসছেন।
আরবী ‘শা’বান’ (شعبان), শব্দটি একবচন, এর বহুবচন হল ‘শা’বানাত (شعبانات), শা’আ-বীন (شعابنين), শা’বানিয়্যী-ন (شعبانين)। এটা باب تفعل – تشعب থেকে গৃহীত। এর অর্থÑ বিক্ষিপ্ততা ছড়ানো ও শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট হওয়া।
ইমাম রাফে’ হযরত আনাস (রা:)-র উক্তি লিখেছেন, হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, এ মাসের নাম ‘শা’বান’ এ জন্য রাখা হয়েছে যে, এ মাসে রোযা পালনকারীর সাওয়াব, মঙ্গল ও সৌন্দর্য শাখা-প্রশাখার ন্যায় বিস্তার লাভ করে, যাতে রোযাদার জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে।

আরবী ১২ মাসের অষ্টম মাস শাবান। শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রটি কোরআনের ভাষায়- ليلة مباركة (লাইলাতুম মুবারাকা) বা বরকতময় রজনী, আর হাদীসের ভাষায়-ليلة النصف من شعبان (লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান) বা শাবানের মধ্য রজনী। তাফসীরের ভাষায় ليلة الصك (লাইলাতুছ্ ছাক) বা সনদপ্রাপ্তির রাত্রি, ليلة النجاة (লাইলাতুন নাজাহ) তথা মুক্তি রজনী। আর আমাদের উপমহাদেশে যাকে শবে বরাত বলে আমরা জানি তা ফারসী ভাষা থেকে উদ্ভূত। শব (شب) বা রাত ও বরাত (برات) বা ভাগ্য, পবিত্রতা, নাজাত, মুক্তি, ত্রাণ ইত্যাদি। এছাড়াও এর আরো অনেক নাম রয়েছে। যেমন- البراءة ليلة বা পাপ মুক্তির রজনী,القسمة ليلة বা বন্টনের রজনী, ليلة التكفير বা গুণাহের কাফ্ফারার রাত, الاجابة ليلة বা দোয়া কবুলের রাত, الملائكة ليلة বা ফেরেস্তাদের ঈদের রাত, ليلة الجاءزة বা প্রতিদানের রাত, الشفاعة ليلة বা সুপারিশের রাত, ليلة الغفران বা ক্ষমার রাত, التعظيم ليلة বা সম্মানের রাত, الرجحان ليلة বা পূণ্যের পাল্লা ভারি হওয়ার রাত, العتق من النار ليلة বা দোযখ থেকে মুক্তির রাত।

পবিত্র কুরআন ও নির্ভরযোগ্য মুফাস্সিরগণের দৃষ্টিতে পবিত্র শবে বরাত ঃ
মধ্য শাবানের রাত্রি যা কোরআনের পরিভাষায় লাইলাতুম মুবারাকা নামে পরিচিত। এ রাতটির মর্যাদা, অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
ইদানিং একটি ভ্রান্ত-মতবাদী দল বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য, আলোচনায় এবং লেখনীতে সর্বদা এ কথা বলে বেড়াচ্ছে যে, লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাতের নির্ভরযোগ্য কোন দলীল কোরআন ও হাদীস শরীফে নেই। যা আছে তাও মাওজু তথা বানোয়াট বা জাল কিংবা সাংঘাতিক পর্যায়ের দুর্বল। অথচ, দেখুন পবিত্র কোরআনে কারীম ও নির্ভরযোগ্য তাফসিরের কিতাবের ভাষ্য-

সূরা দুখানের ১-৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন ঃ
حم-والكتاب المبين- إنا أنزلناه فى ليلة مباركة- إنا كنا منذرين- فيها يفرق كل أمر حكيم-
হা-মীম, এ স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে বন্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক হিকমতের কাজ।

এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য নির্ভরযোগ্য মুফাস্সিরগণের মতামত ঃ

১. তাফসীরে জালালাইন শরীফে ৪১০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
ان انزلناه فى ليلة مباركة هى ليلة القدر او ليلة النصف من شعبان نزل فيها من ام الكتاب من السماء السابعة الى السماء الدنيا انا كنا منذرين-
নিশ্চয়ই আমি তা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আর বরকতময় রাত হল লাইলাতুল ক্বদর (ক্বদরের রাত) অথবা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাত)। কেননা এই রাতে উম্মুল কিতাব (কোরআন শরীফ) ৭ম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে (১ম আসমান) নাযিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।

২. তাফসীরে তাবারী শরীফ পৃষ্ঠা-২২, খন্ড ১০ -এ বর্ণিত আছে-
عن محمد بن سوفة, عن عكرمة فى قول الله تبارك وتعالى (فيها يفرق كل أمر حكيم) قال: فى ليلة النصف من شعبان يبرم فيها أمر السنة وتنسخ الأحياء من الأموات ويكتب الحاج فلا يزاد فيهم أحد, ولا ينقص منهم أحد.
كذا أخرج ابن جرير وابن منذر وابن أبى حاتم وكذا فى روح المعانى-
আল্লাহ তায়ালার বাণী فيها يفرق كل أمر حكيم এর তাফসীরে বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজীদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে একজনও কমবেশি হয় না।

অনুরূপ বর্ণনা করেছেন ইবনুল মুনজির ও ইবনু আবি হাতেম (রা:)। এরূপ রুহুল মায়ানীতেও আছে।

৩. তাফসীরে কুরতুবী পৃষ্ঠা-১২৬, খন্ড ১৬ এ বর্ণিত আছে :
ولها أربعة أسماء: الليلة المباركة, وليلة البراءة, وليلة الصك, وليلة النصف من شعبان-
ইমাম কুরতুবী (রা:) বলেন, এ রাতের ৪ টি নাম আছে-
ক. লাইলাতুম মুবারাকা, খ.লাইলাতুল বারাআত
গ. লাইলাতুছ্ ছাক, ঘ. লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।

৪. তাফসীরে বাগভী পৃষ্ঠা-২২৮, খন্ড ৭ -এ বর্ণিত আছে :
عن ابن عباس رضى الله عنهما أن الله يقضى الأقضية فى ليلة النصف من شعبان, ويسلمها إلى أربابها فى ليلة القدر-
নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন শবে বরাতের রাতে এবং তা সংশ্লিষ্ঠ দায়িত্ববান ফেরেস্তাদের কাছে ন্যস্ত করেন শবে ক্বদরের রাতে।
এ ছাড়াও ১.তাফসীরে ইবনু আবি হাতেম ১২তম খন্ড, ২১৪ পৃষ্ঠা। ২. রুহুল মায়ানী ২৫তম খন্ড, ১১০ পৃষ্ঠা। ৩. বাহরুল মুহীত, ৮ম খন্ড, ২৪ পৃষ্ঠা। ৪. ফাতহুল কাদীর ৪র্থ খন্ড, ৫৭০ পৃষ্ঠা। ৫. যাদুল মাছির ৭ম খন্ড, ১২২ পৃষ্ঠা। ৬. বাগভী, ৭ম খন্ড, ২২৭ পৃষ্ঠা। ৭. নাসাফী ৩য় খন্ড, ৩০২ পৃষ্ঠা। ৮. নিসাপুরী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪৯০ পৃষ্ঠা। ৯. কাশ্শাফ ৪র্থ খন্ড, ২৭২ পৃষ্ঠা। ১০. কান্যুল ঈমান, ১১. নুকুত ওয়াল উয়ূন, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪৯০ পৃষ্ঠা। ১২. দুররে মানসূর ১২তম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠায় ১৫ টি হাদীস রয়েছে। ১৩. খাজেন, ৬ষ্ঠ খন্ড, ১৪৩ পৃষ্ঠা। ১৪. আল বোরহান, ২৩তম খন্ড, ১১৬ পৃষ্ঠা। ১৫. রাযী, ১৭তম খন্ড, ১৩৩ পৃষ্ঠা। ১৬. আলুসী, ১৮তম খন্ড, ৪২৪ পৃষ্ঠা। ১৭. জালালাইন ৪১০ পৃষ্ঠা। ১৮. হাক্কী, ৫ম খন্ড, ৬ পৃষ্ঠা। ১৯. কুরতুবী, ১৬তম খন্ড, ১২৭ পৃষ্ঠা। ২০. সাভী ২য় খন্ড, ৩০২ পৃষ্ঠা। ২১. ইবনে কাসীর, ৭ম খন্ড, ২৪৬ পৃষ্ঠা। ২২. জামিউল বায়ান ২০তম খন্ড, ১৫১ পৃষ্ঠা। ২৩. নুসূকী ৩য় ও ৪র্থ খন্ড, ১২০ পৃষ্ঠা। ২৪. কাদের ৪র্থ খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা। ২৫. মাযহারী ৮ম খন্ড, ৩৬৮ পৃষ্ঠা। ২৬. কাসেমী ৮ম খন্ড, ৩৬৮ পৃষ্ঠা। ২৭. কোশাইরী ৩য় খন্ড, ১৯০ পৃষ্ঠা, ২৮. আবু সৌউদ ৬ষ্ঠ খন্ড, ১৩০ পৃষ্ঠা। ২৯. আয়াতুল আহকাম ৪র্থ খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা। ৩০. রুহুল বয়ান ৩য় খন্ড, ৫৯৮ পৃষ্ঠা। ৩১. কাশেফুল আসরার, ৯ম খন্ড, ৯৪-৯৮ পৃষ্ঠা। ৩২. মাওয়ারদী, ৪র্থ খন্ড, ১০২ পৃষ্ঠা। ৩৩. সিরাজুম মুনির, ৩য়, খন্ড, ৪৫৮ পৃষ্ঠা। এ রকম ২৩১ টি তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুম মোবারাকা বলতে শবে ক্বদরের পাশাপাশি মধ্য শাবানের অর্থাৎ ১৪ শাবানের রাতের কথাও গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে।
তাফসিরে রুহুল বয়ান ৩য় খন্ড ৫৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে– আল্লাহ পাক জাল্লা শানুহু উক্ত রুজি রোজগার ও রিজিক বন্টনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার হযরত মিকাঈল (আঃ) এর উপর, কার্যসমূহ ও বন্দেগীর দায়িত্ব ভার ১ম আসমানের ফেরেস্তা হযরত ইসরাইল (আঃ) এর উপর, বিপদাপদ ও দুঃখ দুর্দশায় দূরীকরনের দায়িত্বভার হযরত আযরাইল (আঃ) এর উপর অর্পণ করেন।

শবে বরাত যে মুসলিম উম্মার জন্য একটি বরকতময় ও ফজিলত পূর্ণ রাত্রি এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্ত মুফাসসিরীন ও মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ রাতকে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

গাউসূল আজম বড় পীর শেখ সৈয়্যদ আবূ মুহাম্মদ আবদুল কাদের জিলানী (র:) তদ্বীয় কিতাব “গুনিয়াতুত্ত্বালেবীন” এর ১ম খন্ডে-এ ৬৮৪ পৃষ্টায় উল্লেখ করেন-
قال الله عز وجل حم والكتاب المبين انا انزلناه فى ليلة مباركة قال ابن عباس رضى الله عنهما حم قضى الله ما هو كائن الى يوم القيمة والكتاب المبين يعنى القران- انا انزلناه يعنى القران فى ليلة مباركة هى ليلة النصف من شعبان وهى ليلة البرأة وقال ذالك اكثر المفسرين-
অর্থাৎ:- আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- হা-মী-ম প্রকাশ্য মহাগ্রন্থ আল কোরআনের শপথ- যে কোরআনকে আমি মুবারক (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এর তাফসীর প্রসংগে বলেন- কিয়ামত পর্যন্ত যা হওয়ার আছে- তা আল্লাহ পাক ফয়সালা করে দিয়েছেন। শপথ উজ্জল প্রকাশ্য গ্রন্থ তথা কোরআনের যাকে আমি বরকতময় রাতে অর্থাৎ শাবান মাসের

মধ্যবর্তী রজনীতে নাযিল করেছি- ঐ ১৫ শাবানের রাতটি হচ্ছে লাইলাতুল বরাআত- এবং অধিকাংশ মোফাসসিরীনে কেরাম এ মত পোষন করেছেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *